সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় হুমকির মুখে পড়েছে হাওরের নয় হাজার ৪০০ হেক্টর জমির বোরো ধানের জমি। ভারতের মেঘালয় থেকে নেমে আসা ঢলে গোয়াইন ও সারী নদীর পানি হঠাৎ বাড়ায় বোরো ধান তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা। ভারতের মেঘালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে গত কয়েকদিন অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় পাহাড়ি ঢলের কারণে গোয়াইনঘাটের পিয়াইন নদীতেও বাড়ছে পানি।
উপজেলার পশ্চিম আলীরগাঁও, পূর্ব আলীরগাঁও, পূর্ব জাফলং, ডৌবাড়ি, রুস্তমপুর তোয়াকুল, নন্দিরগাঁও ইউনিয়নসহ প্রত্যেকটি ইউনিয়নের হাওরগুলোতে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
হাওর অঞ্চলের কৃষকরা আশঙ্কা করছেন, গত কয়েকদিন যেভাবে পানি বাড়ছে, এভাবে পানি বাড়তে থাকলে ২০১৭ সালের মতো অকাল বন্যার সৃষ্টি হবে। ঘরে তোলা যাবে না একমুঠো ফসলও।
গোয়াইনঘাট উপজেলার কৃষকরা একমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভর করে সারা বছর চলেন। সন্তানদের লেখাপড়া, চিকিৎসা সবকিছু তাদের এই বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু গোয়াইনঘাট উপজেলায় আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল। শঙ্কায় আছেন উপজেলার নিম্নাঞ্চল আর হাওরাঞ্চলের বোরো চাষিরা। রোববার (৩ এপ্রিল) রাতে হঠাৎ করে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভেঙে গেছে অনেক নদীর বাঁধ ও যাতায়াতের রাস্তা। ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অনেকের দরকারি জিনিসপত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হঠাৎ করে পাহাড়ি ঢল নেমে আসে। নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে উপজেলার বেশিরভাগ নিম্নাঞ্চল। অনেক বোরো ক্ষেতের জমিতে পানি ঢুকে গেছে এমন খবরও পাওয়া গেছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতের অনেক নৌকা চলে এসেছে বাংলাদেশে। আবার বাংলাদেশের অনেক নৌকা তলিয়ে গেছে পানির নিচে।
উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহাব উদ্দিন সিহাব বলেন, “পাহাড়ি ঢলের কারণে আগাম বন্যা দেখা দিয়েছে। রোববার রাতে আমাদের উপজেলায় কোনো বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আমাদের ঠিক ওইপাশে বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ স্থান ভারতের চেরাপুঞ্জি ও মেঘালয় থেকে হঠাৎ করে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভেঙে গেছে লুনি নদীর বাঁধ (আনফরের ভাঙা)। সকাল থেকে মানুষ পারাপারে দুর্ভোগ বেড়েছে। এদিকে হাদারপার বাজার থেকে গোরাগ্রাম যাওয়ার নদীর ওপর বাঁধ ভেঙে অনেক কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।”
সাহাব উদ্দিন আরও বলেন, “অপ্রত্যাশিত বন্যায় নিম্নাঞ্চল ও হাওরাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। অনেকের দরকারি অনেক কিছু যেখানে-সেখানে ফেলে রাখা ছিল। অপ্রত্যাশিত বন্যা তা ভাসিয়ে নিয়েছে। এমনকি হাওরাঞ্চলের বোরো ফসলের জমিতে পানি ঢুকে গেছে। শুধু উপরের কিছু জায়গা বাকি রয়েছে। পাথর কোয়ারি বন্ধ থাকায় কর্মসংস্থান হারিয়ে উপজেলায় বসবাসকারী নিম্ন আয়ের দিনমজুর মানুষেরা কৃষিকাজে মন দিয়েছিল। এ বছর উপজেলার অনেক পতিত জায়গায কৃষিকাজের আওতায় এসেছে। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় তলিয়ে গেছে অনেক কৃষকের ফসলি জমি।”
চেয়ারম্যান আরও বলেন, “বর্তমানে কৃষকরা দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন। দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন তারা। কৃষকদের মাথায় হাত পড়েছে। এখন পর্যন্ত পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে এবং ছোট ছোট হাওরে পানি ঢুকে গেছে। হাওরের বোরো ও ইরি ধান পানিতে নিমজ্জিত।”
উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের নওয়াগাঁও গ্রামের কয়েকজন কৃষক জানান, “আমরা প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন হাওরে বোরো ধান লাগিয়েছি। সবে মাত্র ধানগুলোতে থোড় বের হতে চলেছে। এরই মধ্যে গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল নামছে। শুনেছি নদীর পানিও বাড়ছে। এরই মধ্যে না কি গোয়াইনঘাট এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের শিলচান্দ হাওরের একমুঠো ধানও ঘরে তোলা সম্ভব না।”
তারা আরও বলেন, “২০১৭ সালের অকাল বন্যার পর থেকে বোরো ধান ভালো হওয়ায় এবার আমরা ৩০ বিঘা জমি চাষ করেছি। প্রতি বিঘা জমিতে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করেছি ধান পাওয়ার আশায়। ধান ভালো হয়েছে। মাত্র ১৫ দিন আবহাওয়া ভালো থাকলে কৃষকদের ঘরে ফসল তোলা সম্ভব। আর যদি এভাবে পানি বাড়তে থাকে, তাহলে একটি ধানও ঘরে তোলা সম্ভব নয়। আমরা অনেক কষ্ট করে টাকা-পয়সা ঋণ করে বোরো ফসল ফলিয়েছি। কিন্তু উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে হাওর অঞ্চলে পানি বেড়ে যাওয়ায় আমরা কৃষকরা দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি।”
এ বিষয়ে জাফলং টুরিস্ট পুলিশের ইনচার্জ রতন শেখ বলেন, “রোববার রাতে হঠাৎ বন্যায় জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে পর্যটন ব্যবসায়ীদের অনেক কিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এছাড়া সীমান্তবর্তী ভারতের ২৫টি নৌকা বাংলাদেশ সীমানায় চলে এসেছে এবং বাংলাদেশের কয়েকটি নৌকা পানিতে তলিয়ে গেছে।”
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রায়হান পারভেজ বলেন, “বন্যা বৃদ্ধি পাওয়ার খবরে আমি পরিদর্শনে গিয়েছি। আমি উপজেলার পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের নলজুড়িতে গিয়ে দেখি কিছু নিচু জায়গার ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। তবে দুই-একদিনের ভেতরে বন্যা চলে গেলে বোরো ধানের ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।”
এ সময় কত হেক্টর জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে জানতে চাইলে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, “এখনও পুরো উপজেলা পরিদর্শন শেষ হয়নি। পুরো উপজেলা পরিদর্শন শেষ হলে হিসাব করে বলতে পারব কত হেক্টর জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত গোয়াইনঘাটে নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।”
তবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দমকা হাওয়া ও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। শুকিয়ে যাওয়া গোয়াইন, পিয়াইন ও সারী নদীর বুকে বিচরণ করছে পাহাড়ি ঢল। এভাবে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পুরো গোয়াইনঘাটের উপজেলায় বোরো ধানের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সারী, বড় নয়াগাঙ ও রাংপানি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার হেক্টর বোরো ধান।
জানা গেছে, মেঘলী, বন্দরহাটি, লামাপাড়া, ময়নাহাটি, জাঙ্গালহাটি, মজুমদারপাড়া, নয়াবাড়ী, হর্নি, বাইরাখেল, গোয়াবাড়ী, তিলকৈপাড়া, বড়খেল, ফুলবাড়ী, ডিবিরহাওর, ঘিলাতৈল, হেলিরাই, মুক্তাপুর, বিরাইমারা হাওর, লামনীগ্রাম, খারুবিল, চাতলারপাড়, ডুলটিরপাড়, ১ নম্বর লক্ষীপুর, ২ নম্বর লক্ষীপুর, আমবাড়ী, ঝিঙ্গাবাড়ী, কাঠালবাড়ী, নলজুরী হাওর, বালিদাঁড়া, রামপ্রসাদ, থুবাং, বাউরভাগ উত্তর, বাউরভাগ দক্ষিণসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢলে সারী নদী, বড় নয়াগাঙ এবং রাংপানি নদীর পানি বিপদ সীমার কাছাকাছি রয়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে।
সারী-গোয়াইন বাঁধ প্রকল্পের কর্মকর্তা মো. আলা উদ্দিন বলেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে পানি নিম্নাঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টি অব্যহত থাকলে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে।
এ নিয়ে জৈন্তাপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আল বশিরুল ইসলাম বলেন, “পাহাড়ি ঢলে ও টানা বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং জনসাধারণকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।”